রোদের চিঠি – (শেষ খন্ড)
(১৪)
মিতু এসেছে নিশার বাড়িতে। সাথে তার ছেলে, রাজমান। “কি সুন্দর মাশাআল্লাহ, আব্বুটা কোলে আসো, কোলে আসো” বলে নিশা রাজকে কোলে নিলো। রাজ ভ্যা করে কাঁদছে, নিশা থামানোর চেষ্টা করছে। মিতু হাসতে হাসতে বললো, ও ইদানিং এইরকম করে, একটু পরই ঠিক হবে দেখিস।
রাজমান থামলো নিশা চকোলেট দেওয়ার পরে। নিশা, কবে বিয়ে করবি বলতো, চাকরি চাকরি করে অস্থির ছিলি, সেটাও হইছে এখন বিয়ে তো কর- মিতু এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো।
– কেনরে, মা কিছু বলেছে তোকে?
-না না, আমিই বললাম, আমার ছেলে বড় হয়ে গেলো, আর তুই বিয়েই করলি না এখনো।
আমিও তো পড়া শেষ করেই বিয়ে করেছি, নাকি।
চাকরিও করছি।
নিশা বললো, মিতু আজ আসিফের সাথে দেখা হয়েছিলো!
-আসিফ ভাই, আল্লাহ কি সুন্দর দেখতে লাগে এখন তাই না! সেই গুন্ডা ভাবটা নাই এখন, পুরোপুরি রাজনীতিবিদ!
পাঞ্জাবী, চশমা, চাদর খুবই ফিটফাট এখন!
তোকে কিছু বললো?
-আমাকে তো ঝাড়ি ছাড়া কোনদিন কিছু দেয় নাই রে, আজকে চৌধুরী বাড়ির রাস্তায় গিয়েছিলাম।
ওখানে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে একা একা।
নিজে দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে বললো, একা কেন গিয়েছি!
-সুবহানার জন্য মনে হয়!
-সুবহানা কে?
-এমপি সাহেবের ভাতিজি, কলেজেই তো পড়ে, চিনবি আস্তে আস্তে, এইখানে ও ছাড়া কেউ ওমন জামাকাপড় পরে না।
-সুবহানার জন্য আসিফ দাঁড়াবে কেন?
-সবাই বলে এমপি সাহেবের তো মেয়ে বাকি নাই, তাই সুবহানার সাথে আসিফের বিয়ে দিবে!
-আসিফ বিয়ে করবে??
-করতেও পারে, রাজনীতির জন্য কি না করে, এমপি সাহেবের আত্মীয় হওয়া মানে বোঝো, তার বয়স হইছে, সামনে আসিফ ভাইকে ভোটে দাঁড় করাবে।
– আসিফ রাজনীতির জন্য বিয়ে করবে না।
-বাবাগো, এখনো এত প্রেম তোর! এত ছেলে তো দেখছো, মনটা ফিরাতে পারো নাই!!
-মিতু প্রেম ট্রেম না, আমার মনে হইছে তাই বলছি। তবে ওর যদি ওই মেয়েকে ভালো লাগে, তাইলে বিয়ে করতে পারে।
-কি জানি, সবাই তো বলে! আসলে আসিফ ভাইয়ের এত কম বয়স, নিজের অবস্থা ফিরছে এমপি সাহেবের হাত ধরে, তার সাথে ব্যবসা করে, বাড়িটাও করছে, নিচে মার্কেট, এগুলো তো এমনি এমনি করে দেয় নাই, স্বার্থ তো আছে।
নিশা আর কথা বললো না, বুকের ভেতরটা কেমন জানি লাগছে, আসিফ অন্য একজনকে বিয়ে করবে, কিন্তু কেন, তার কি নেই! আসিফকে জোর করে চুমু খেয়েছিলো নিশা, সেই কতবছর আগে, আসিফের কি মনে আছে? নাকি ওই সুবহানা না কি মেয়েটাকে রোজ সকাল বিকাল চুমু খায় এখন!
যা খুশি করুক। ধূর ভাল্লাগছে না, ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়সটা খুব বিরক্তিকর, এখানে আবেগ ভালোবাসা থাকে, কিন্তু প্রকাশ করা যায় না। নিশা এখন কলেজের লেকচারার। ও নিশ্চয়ই কোন সিনক্রিয়েট করতে পারবে না। পারলে আসিফকে আজ সবার সামনে চুমু খেয়ে চলে আসতো।
বিকেলের শেষ শেষ সময় তকিব, মামুন, মানস সবাই এলো নিশাদের বাড়িতে। ওরা সবাই টিচার্স ডরমিটরিতে থাকছে। নিশার বাসা এখানেই বলে মাঝে মাঝেই চলে আসে। এদের মধ্যে তকিব ছেলেটাকে নিশার বাবা মায়ের বেশ পছন্দ।
নিশাও ওর সাথে কথা বলে দেখেছে। বিয়েটা হলে খারাপ হয়না, দুজন একই সার্ভিসে আছে।
নিশা একটু চুপচাপ আজ। মিতুর সাথে সবার আলাপ হয়েছে, সবাই গল্প করতে করতে চা মুড়ি মাখা আর পাকোড়া খাচ্ছিলো, নিশার শুধু মনে হচ্ছিলো কখন সবাই যাবে, ও একটু একা থাকবে কিছুক্ষণ।
তকিব খেয়াল করলো, নিশা কিছু হয়েছে তোমার?
এত চুপচাপ কেন?
-না, কিছু না, ঠিক আছি।
মিতু আস্তে করে বললো, যা পিছনে ফেলে চলে গেছিস, সেটা নিয়ে মন খারাপ করিস না প্লিজ।
নিশা আস্তে একটা নিঃশ্বাস ফেললো, ফেলে আর গিয়েছে কই , এক মুহুর্তেও তো ভুলতে পারেনি! মনে হয়েছে পাশে আছে সে। এখন কি ভুলতে হবে! কিভাবে পারবে নিশা!
###
গতকাল রাতে তকিব, মামুন নিশার বাসায় এসেছিলো, গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়েছে। তকিব ভীষণ মিশুক , নিশার মায়ের সাথে রান্নাঘরে বসে গল্প করেছে। নিশার মায়ের বার বার মনে হচ্ছে, আহা, এমন ছেলেটা যদি নিশার বর হতো! নিশা তো বিয়ে করতেই চায় না।
নিশা কলেজে বের হচ্ছিলো, ওর মা বললেন, তকিবকে নিয়ে আসিস দুপুরে। ম্যাচে কি না কি খায় ছেলেটা!
-কি না কি খাবে কেন মা? ওদের যথেষ্ট ভালো মেনু থাকে, বাবুর্চিও ট্রেইন্ড।
-তারপরেও, পরিবারের কাছে থাকেনা ছেলেটা, নিয়ে আসিস তো!
-সে তো ঢাকায়ও ছিলো না।
-নিশা, কথা বাড়াস না তো, নিয়ে আসিস মা।
নিশা হাসলো, মায়ের ইচ্ছে সে ভালোই বুঝতে পারছে। কিন্তু নিশা মনে মনে আসিফ ছাড়া কাউকে কাছে টানতে পারছে না। সমস্ত চিন্তা জুড়ে আসিফ আর আসিফ। এই ছেলেটা কি জাদু করেছে নিশাকে, এতগুলি বছর ধরে মনের মাঝে বসে আছে।আচ্ছা মিতু বলেছিলো, আসিফ নাকি বিয়ে করবে, কই তেমন কিছু তো শুনলো না অন্য কোথাও। আসিফ খুব চাপা স্বভাবের, নিশার দিকে একবারো তাকায় না। অবশ্য বেশ কিছুদিন দেখাও হয়নি! কোথাও গিয়েছে বোধহয়!!
নিশা কলেজের গেটে রিক্সা থেকে নামলো। তকিব এসেছে গেটে, নিশাকে দেখে বললো, নিশা, তোমাকেই আনতে যাচ্ছিলাম।
নিশা ভাড়া মেটাতে মেটাতে বললো, আমাকে কেন আনতে যাচ্ছেন ভাইয়া, আমি তো এসেই পড়লাম।
-নাহ, আমি একটু আগেই চলে আসছি, ভাবলাম তোমার কাছ থেকে কয়েকটা গল্পের বই নিয়ে আসি, এসো লাউঞ্জে যাই, ব্রেকফাস্ট করিনি এখনো।
নিশা বললো, চলুন যাই।
আসিফ সাধারণত কলেজে খুব একটা আসে না। নিশা জয়েন করার পর থেকে টুকটাক অজুহাতে মাঝে মাঝেই সংসদে আসছে, যদিও কেউ জানে না আসল কারণটা কি। ও খুলনা গিয়েছিলো ব্যবসার কাজে। গতরাতে ফিরেছে। আজ সকালে পার্টি অফিসে এসেছে, সেখান থেকে সংসদের দিকে আসছিলো, দূর থেকেই চোখে পড়লো নিশা তকিবের সাথে কলেজে ঢুকছে।
আসিফ সংসদে ঢুকলো। সংসদের ট্রেজারার রায়হান ছিলো অফিসে, আসিফকে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়ালো। আসিফ ওকো বসতে বললো, তারপর জিজ্ঞেস করলো, তকিব সাহেব কোন ডিপার্টমেন্টের টিচার?
রায়হান বললো, ভাই, ইংলিশের।
-ওহ আচ্ছা, ক্লাশ করেছিস, ওর ডিপার্টমেন্টই তো!
-জি ভাই, ভালো পড়ায়, ঢাকা ইউনিভার্সিটির তো!
ওহ আচ্ছা, ঢাকা ইউনিভার্সিটির তাহলে, নিশার সাথে কি আগেই আলাপ ছিলো নাকি? ধূর, আলাপ থাকলেই বা কি, আসিফের কি আসে যায়! আসলেই আসে যায় আসিফের, বিরক্ত লাগছে।
রায়হান বললো, নিশা ম্যাডামের সাথে খুব ভাব মনে হয়, তাদের বাসায়ও যায়, অবশ্য সবাই একসাথে যায়।
আবার দেখি অফ পিরিয়ডে গল্প করে!
আসিফ বললো, ভাব হলে হবে, টিচারদের নিয়ে গবেষণা বাদ দে, পড়ায় মন দে, নয়তো রাজনীতি কর! পরচর্চা করে এক পয়সারও লাভ হবে না।
রায়হান লজ্জা পেয়ে গেলো, আসিফ ভাই অন্যরকম মানুষ, এই গল্প অন্য সবার সাথে জমে উঠতো, সে পাত্তাই দিলো না!নিশা ম্যাডামও মারাত্মক, মাথা ভরা চুল, একটা খোঁপা বা বেনী করে রেখে দেয়! রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পোলাপান তো ম্যাডাম বলতে অজ্ঞান!
আসিফ একটা নিঃশ্বাস ফেললো, নিশাকে বলতে হবে, বিয়ে করলে করে ফেলো, এভাবে মিশলে কথা হয় ছেলেপেলেদের মধ্যে!
নিশাটা একদম বোকা, কিচ্ছু বোঝে না, এটা কি ইউনিভার্সিটি নাকি যে কেউ কিছু বলবে না!
আহারে, এই বোকা মেয়েটা আসিফের জীবনটা জুড়ে বসে আছে, অন্য কেউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
###
পলাশের দিন শেষ হলো। একটু একটু বৃষ্টি নামছে আজকাল। আজই তো আকাশে মেঘের নৃত্য চলছে। নিশার সাথে ছাতা নেই। কলেজ থেকে বের হতে পারছে না। তকিবকে ফোন করে বললো, একটা ছাতা নিয়ে এগুতে। প্রায় দুটো বাজে। নিশার টিউটোরিয়াল নিতে হয়েছে বলে আটকা পড়ে গেছে। সবাই চলে গেছে আগেই। কমনরুমে কিছু মেয়েরা আছে, নিশা দোতলায় দাঁড়িয়ে আছে, আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নামুক একবার।
আরো কয়েকটা মেয়ে অন্য ডিপার্টমেন্ট বোধহয়, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। এরা সবাই একটা গ্রুপ, সাজগোজ করেছে সবাই।
নিশাকে ফর্মালি সালাম দিয়ে সরে দাঁড়ালো একটু দূরে।
নিশা দেখলো আসিফের গাড়িটা ঢুকছে, সংসদের সামনে থামলো। পাশের মেয়েগুলি মুখ টিপে হাসতে লাগলো, সুবা, তোর হিরো এসেছে, নিয়ে যাবে বাসায়। নিশা তাকিয়ে দেখলো, মেয়েটা বেশ সুন্দরী, এই তাহলে সুবহানা। সুবহানা বললো, আমি আটকে আছি আর ও নিতে আসবে না! এটা হতে পারে নাকি! আমি যাই, সুবহানা নিচে নামলো, বেশ বৃষ্টি পড়ছে।
সুবহানা ছাতা নিয়ে আসিফের গাড়ির কাছে চলে গেলো। আসিফের একটু কাজ ছিলো সংসদ অফিসে। সুবহানা অফিসে গিয়ে আসিফকে বললো, আসিফ ভাই, আটকে পড়েছি, একটু লিফট দিতে হবে। আসিফ বললো, আচ্ছা বসো গাড়িতে। কুদ্দুসকে বলো দিয়ে আসবে।
কুদ্দুস আসিফের ড্রাইভার, সুবহানা বললো, আপনিও চলেন কাজ শেষ হোক, একসাথে যাই। এতগুলো মানুষের সামনে মেয়েটাকে না করা যায় না, আসিফ বললো, আচ্ছা বসো।
জোরে বৃষ্টি আসছে। নিশার ইচ্ছে করছে ভিজতে।কিন্তু ও তাকিয়ে আছে আসিফ কখন বের হয়, এটা দেখতে।
মেয়েগুলি নিচে চলে গেলো একটু আগে।
মিনিট দশেক পরে আসিফ বের হলো। সুবহানা গাড়িতে উঠলো। আসিফ কেন যেন কলেজের ২ নং বিল্ডিং এ তাকালো, নিশা তাকিয়ে আছে। এতদূর থেকে বোঝা না গেলেও আসিফ বুঝতে পারে নিশা। সুবহানার সাথে গাড়িতে উঠতে দেখবে, কি না কি মনে করে আবার। উফফ, মাঝে মাঝে জীবনে এত অদ্ভুত পরিস্থিতি আসে! কেন আসে কে জানে!
নিশা দেখলো আসিফ সুবহানাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো, নিশার চোখে পানি চলে এলো, কিছুতেই আটকাতে পারলো না। তকিব এসে পড়লে কি উত্তর দেবে নিশা, তাই বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে কলেজের পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসলো, বৃষ্টির সাথে অশ্রু মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে, কেউ বুঝবে না।
তকিব এসে পড়েছে, নিশাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে ডাকলো- নিশা উঠে এসো, ঠান্ডা লেগে যাবে।
গতরাতে আলতা দিয়েছিলো, সেই কবে একবার আসিফ বলেছিলো, নিশা তুমি আলতা দাও না? তোমার পা অনেক সুন্দর, আলতা দিলে ভালো লাগবে, নিশা মাঝে মাঝে আলতা দেয় তারপর থেকে, আসিফ না থাকুক ওর কাছে, আসিফের সব কিছু নিশা আগলে রাখে, খুব যত্নে।
আসিফ পার্টি অফিসের সামনে নেমে গেলো, কুদ্দুসকে বললো সুবাকে পৌছে দিয়ে আসতে।
তারপর অফিস থেকে ছাতা নিয়ে কলেজের দিকে গেলো, কিন্তু কিন্তু সংসদের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো, নিশা পুকুর ঘাট থেকে উঠে আসছে, তকিবের সাথে।
নিশা তকিব সাহেবের সাথে বৃষ্টিতে ভিজেছে। তাহলে টুকটাক কানাঘুষো হয়ত সত্যি, নিশার সাথে তকিব সাহেবের বিয়ের কথা চলছে। নিশার সামনে এগিয়ে আসছে, আসিফ সরে গেলো, এই মুহুর্তে ওর সামনে গেলে ও অপ্রস্তুত হবে। নিশা তকিবকে বললো, তকিব ভাই, আমি যাই, আপনে ডরমিটরিতে চলে যান, বৃষ্টির মধ্যে আর আসতে হবে না।
তকিবও ভাবলো এখন আর গিয়ে কি হবে, তার চাইতে একটা ঘুম দিই গিয়ে। নিশা রিক্সায় উঠলো, তকিবও চলে গেলো। আড়াল থেকে আসিফের একবার মনে হলো, তকিব সাহেব কেমন ভদ্রলোক, নিশাকে একা যেতে দিলো!
আসিফ পুকুর ঘাটে গেলো একা একাই। বৃষ্টিতে ভেজা পুকুরঘাটে থেকে থেকে লালচে জল, নিশার পায়ে আলতা ছিলো বোধহয়।
আসিফ বসে রুমালে আলতা মেশানো জলটা রুমালে মুছে নিলো, এই আলতাও একটু আগে নিশার পায়ে ছিলো বুঝি! এত ভালোবাসা বুকের কোথায় লুকিয়ে থাকে, আসিফ জানে না। হোক নিশার বিয়ে, তারপরেও নিশা শুধুমাত্র আসিফেরই থাকবে। কেউ কখনো আসিফের বুকের ভেতর থেকে নিশাকে সরাতে পারবে না। সত্যি বলতে কেউ কখনো আসিফকে নিশার মতো ভালোবাসেনি।
আজ যেই আসিফ ভাইয়া আসিফ ভাইয়া করুক, সেদিনকার গুন্ডা আসিফকে ভালোবেসে জড়িয়ে রেখেছিলো শুধু নিশা।
আসিফের তখন কিছুই ছিলো না, তবুও নিশা কেমন পাগলের মতো ভালোবেসেছিল আসিফকে। আসিফের চোখ ঝাপসা হয়, ভাগ্যিস তখনো বৃষ্টি হচ্ছে, তাই অশ্রু আর বারিধারা একাকার হয়ে যায়, কেউ আলাদা করতে পারে না। একটু আগেই এখানে নিশা কেঁদেছে, এখন আসিফ কাঁদছে, দুজনের অশ্রু কি তবে এক হয়ে যাচ্ছে??
এটাও হয়তো অদৃশ্য কারো ইচ্ছে!!
###
আসিফ পার্টি অফিসে, রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। আরো কয়েকজন আছে। আজ দুপুর থেকেই অনেক বৃষ্টি হয়েছে।
আসিফ আজ আর বাড়ি ফিরবে না। পার্টি অফিসের সাথেই একটা রেস্ট রুম আছে।
নিশার জ্বর জ্বর লাগছে, দুপুরে বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক হয়নি। একটু পরে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো, উল্টো পাল্টা কথা মাথায় ঘুরছে। আসিফের ফোন নম্বরটা আছে, একটু ফোন করে জানতে ইচ্ছে করছে, আসিফ কি সত্যি ওই সুবহানা মেয়েটাকে বিয়ে করবে? ওকে ভালোবাসে? নিশার মতো ভালোবাসে?
নিশা ফোন করলো, আসিফের ফোনে এই নম্বরটা সেভ করা, কখনো ভাবেনি নিশা ফোন করবে। পার্টির ছেলে গুলোর সাথে কথা বলছিলো, কলেজে সামনে নবীন বরণ প্রোগ্রাম করবে, দলের পক্ষ থেকে। কত কি ফান্ডিং, কি কি প্ল্যান এসব নিয়েই মিটিং চলছে।
নিশার ফোন দেখে আসিফ কেটে দিলো। দুবার কাটার পরে নিশা ফোন রেখে দিলো। সবাইকে বের করে দিয়ে আসিফ ফোন ব্যাক করলো নিশাকে।
নিশা ভণিতা না করেই বললো, খুব ব্যস্ত আপনি, ফোন ধরারও সময় পান না!
-একটু ব্যস্ত ছিলাম নিশা, বলো এখন। ভয়েস এমন শোনাচ্ছে কেন? ঠান্ডা লাগছে?
-হুম একটু, দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম।
-কেন ভিজলে? তোমার তো ঠান্ডা লেগে যায়!
-ইচ্ছে হয়েছে তাই! কখন ফিরলেন এমপি সাহেবের ভাতিজিকে পৌছে দিয়ে, শুনলাম বিয়ে করছেন সামনে!
-কে বলেছে তোমাকে?
-কে বললো সেটা তো খুব জরুরী নয়, সত্যি তাহলে!
-কি মনে হয়, সত্যি? আমি তো জেনেছি তুমি বিয়ে করছো, তকিব সাহেবকে! তাই না?
-আমার মনে হওয়ায় কি আসে যায়, ভালোই হবে, আপনিও রাজনীতি করেন, ওদের পরিবারও রাজনীতির সাথে জড়িত।
-দুপুরে একা একা গেলে কেনো নিশা, তকিব সাহেব পৌছেে দিলেন না কেন তোমাকে?
-তার মানে আপনি দেখেছেন, কিন্তু কোথা বসে দেখলেন?
-দেখি বা শুনি, সত্যি তো তুমি একাই ফিরেছো!
-দেখার মধ্যে সবসময় সত্যি থাকে না!
-একদম ঠিক, দেখার মধ্যে সত্যি থাকেনা নিশা, নিজেও সেটা বিশ্বাস করো।
-আপনি কোথায় এখন? বাসায়?
-না পার্টি অফিসে!
-আমি একটু আসবো?
– এত রাতে, তুমি কেন আসবে?
-আপনাকে চুমু খাবো, জড়িয়ে ধরে চুমু খাবো, সেই সেদিনকার মতো!
আসিফের কান ঝিম ঝিম করে উঠলো! নিশা এসব কি বলছে!
-নিশা তোমার জ্বর এসেছে বোধহয়, উল্টো পাল্টা বলছো!
-না, আমি উল্টো পাল্টা বলছি না, সেই ক্লাশ টেন থেকে ভালোবাসি, আপনিও ভালোবাসতেন আমাকে, এখন আর বাসেন না, এখন…. এখন রাজনীতির প্রয়োজনে এম পি সাহেবের ভাতিজীকে বিয়ে করবেন, বিয়ে করুন, কোন সমস্যা নেই, আমিও তকিব ভাইকে বিয়ে করবো! শুধু তার আগে আপনাকে একবার চুমু খাবো, মন ভরে চুমু খাবো, সেদিনকার তৃষ্ণা আমি এখনো বুকে নিয়ে ঘুরি, এই তৃষ্ণা মেটাতে হবে! আর কিছুই তো চাইনি!
-নিশা, সোনা মণি, ফোনটা রাখো এখন, একটু ঘুমাও, আমি তোমার সাথে সকালে কথা বলবো, তোমার এই কথা কেউ শুনে ফেললে তুমি অপ্রস্তুত হবে।
-ফোন রাখবো না আমি, সারারাত কথা বলবো, আপনিও বলবেন, কিভাবে আদর করবেন আমাকে সেটা বলবেন!
বুঝতে পারছেন……
আসিফ ফোন কেটে দিলো, নিশা সেন্সে নেই, মনে হয় অনেক জ্বর এসেছে। আহারে, যদি কাছে যাওয়া যেতো!
অবশ্য নিশা তো বাসায়, ওর বাবা মা তো আছে, যত্নেই থাকবে।
আসিফ ফোন কেটে দেওয়ার পরে নিশা কতক্ষণ পাগলের মতো কাঁদলো, আসিফ ওকে ভালোবাসে না, একদম বাসেনা, আসিফ বিয়ে করবে। কেন করবে!!
ওকে, আমিও বিয়ে করবো, কালই মাকে তকিব ভাইয়ের বিষয়ে হ্যা বলে দিবো।
কাঁদতে কাঁদতে নিশা ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।
ঘুম হয়না আসিফের। নিশার চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। নিশা এড পাগলামি করছে, ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে? একটাই ভয়, না করে দিলে একটা ভীষণ অসম্মানে পড়তে হবে, আসিফের একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে, এই বিষয়টা নিয়ে সেটা নড়বড়ে হতে দেওয়া চলে না। কি করবে আসিফ, একদিকে নিশার পাগল করা ভালোবাসা, আর একদিকে এতদিনে তিলে তিলে গড়া অবস্থান, সম্মান। কোন দিকে যাবে সে?
নিশার ঘুম ভাঙলো একটু বেলা করে। ঘামছে খুব, বালিশ ভিজে গিয়েছে চুল ঘেমে। মাকে বললো গরম পানি করে দিতে, উষ্ণ গরম পানি দিয়ে শাওয়ার নিলে ফ্রেশ লাগবে।
নিশা শাওয়ার নিলো একটু বেশি সময় ধরে। তার আগে বেডশিট বালিশের কভার পাল্টে দিলো। গতরাতের পাগলামির কথা এখন মনে নেই, তবে আসিফ কিছু একটা বলেছিলো বোধহয়।
ফ্রেশ হয়ে নিশা ব্রেকফাস্ট করতে এলো। রুটি খেতে ইচ্ছে করছে না। কাঁচা মরিচের আলুভর্তা, সর্ষে তেল দিয়ে গরম ভাতে মেখে নিলো, সাথে ডাল।
নিশার মা এসে জিজ্ঞেস করলেন, মুখটা শুকনো লাগছে কেনো মা, ঘুৃম হয়নি?
-হয়েছে তো, মরার মতো ঘুমিয়েছিলাম রাতে।
-কথা কি অবস্থা!
-বাবা কই গেলো?
-বাজারে মনে হয়। ব্যাগ নেয়নি অবশ্য।
-হুম, তকিব ভাই কিছু বলেছে তোমাকে?
-সেরকম কিছু বলেনি, তোকে বলেছে?
-না, একবার বলেছিলো আন্টি মানে তোমার সাথে কথা বলবে, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
-তুই তো কিছু বলিস না মা!
-দেখো, তোমাদের যা ভালো মনে হয়, আমার সমস্যা নেই!
নিশার মা মনে মনে দুবার আলহামদুলিল্লাহ বললেন, মেয়েটার মন ফিরেছে। কেন যে এতো দিন বসে ছিলো! নিশার বিয়ের প্রস্তাব আসছে সেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পর থেকে। কত শত প্রস্তাব যে তিনি ফিরিয়েছেন, তার কোন হিসেব নেই।
আর এত প্রস্তাব ফেরালে মানুষ খারাপ ভাবে, ভাবে মেয়ের কোন সমস্যা আছে নিশ্চয়ই।
আজই তকিবকে ফোন করে বলবেন, ওর ফ্যামিলি থেকে যেন কথা বলে ওদের বিষয়ে।
ছেলেটা কয়েকবার বলেছে, নিশা খুব ভালো মেয়ে আন্টি!
তিনি বুঝতে পেরেছেন, তকিব কি বলতে চায়।
নিশার বাবাকে ফোন করে বাসায় ফিরতে বললেন তিনি।
আর দেরী করতে ইচ্ছে করছে না।।