অতিথি
শায়লা দাঁড়িয়ে ছিলো বাসার সামনে।
আরিফ নতুন বাসায় মালামালগুলো তুলছিলো।
আরিফের সাথে সাহায্য করছে দুজন ভ্যানওয়ালা, তবে
শায়লাদের আসবাবপত্র খুব বেশি নয়।
সংসারও বেশিদিনের নয়।
এই বাসাটা মেইনরোডের একদম সাথেই।
এখান থেকে আরিফ অফিসের বাস ধরতে পারবে সহজেই। তাছাড়া মেইনরোড সাথে হওয়ায়, নিরিবিলি হবে না কখনো।
ওদের ফ্ল্যাটের সামনে লম্বা বারান্দা।
শায়লা ভাবছিল, এই বারান্দায় কাপড় শুকানো যাবে না, রাস্তার সব ধূলা এখানে জমা হওয়ার কথা।
বারান্দা থেকে নিচের দোকানগুলো দেখা যায় না। যাওয়ার কথাও নয়, কারণ দোকানগুলো এই বাসার নিচতলায়। মেইনরোড সাথে হওয়ায় নিচতলাটা মার্কেট করে দেওয়া হয়েছে।
নিচে তিনটা দোকান। চারটা হতে পারতো কিন্তু ওয়ালটন একসাথে দুটো দোকান নিয়ে বড় শোরুম দিয়েছে।একটা ফ্যাশন হাউজ, নাম “আয়োলিতা”।
এটা কর্ণারে, মাঝখানে একটা স্টেশনারী টাইপের দোকান। এধরণের দোকানকে শায়লা বলে বিবিধ দোকান, কারণ এখানে কি কি আছে তার তালিকা করলে দাড়ায়,
১/ ফটোকপি মেশিন
২/প্রিন্টার, সাথে কম্পিউটার, অনলাইনে ফরম পূরণ করা হয়।
৩/ বিকাশ, রকেট।
৪/ ফ্লেক্সিলোড
৫/ কলম, কাগজ, ফাইল পাওয়া যায়।
৬/কয়েক প্যাকেট বিস্কুট ঝুলানো আছে, কেউ কেনে না মনে হয়, গত পনের দিন আগে যখন বাসা দেখতে এসেছিলো, সেদিন থেকে একই রকম ঝুলছে।
৭/ সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস।
একটা কাগজে টাইপ করে লেখা, “জমি কেনা বেচায় মধ্যস্ততা করা হয়”। দোকানে স্কচটেপ দিয়ে লাগানো আছে।
শায়লা ভাবছিল ফ্যাশন হাউজের কথা।
দোকানের সামনেই একটা সাত আট বছরের বাচ্চা সাইজের ম্যানিকুইন রাখা।
শায়লা যেদিন বাসা দেখতে এলো, সেদিন মনে হয়েছিল, একটা বাচ্চা ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে, একবার অন্যমনস্ক হয়েছিলো, পরে দেখেছে চোখের ভুল, ওখানে ম্যানিকুইন রাখা।
জিনিসপত্র তোলা হয়ে গেলে আরিফ বললো, এখন এসো ভেতরে, অনেক কিছু গোছাতে হবে, বলে আরিফ উপরে উঠে গেল।
শায়লা উঠতে যাচ্ছিল, উপর থেকে হুড়মুড় করে একটা ছেলে নামতে গিয়ে ধাক্কা লাগলো, ছেলেটা পর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। তারপর দ্রুত চলে গেল।
মোটামুটি গোছানো হয়ে গেল অল্প সময়েই।
আরিফ বললো, আজ আর রান্নার ঝামেলা করতে হবে না, আমি খাবার নিয়ে আসি, দরজা খুলে বেড়োতেই বাড়িওয়ালার বাসা থেকে একজন এসে বললো, আপনারা আজ আমাদের বাসায় খাবেন।
আরিফ না করছিল, কিন্তু লোকটি শুনলো না, বাড়িওয়ালা চাচার আদেশ।
অগত্যা শায়লাকে নিয়ে আরিফের যেতেই হলো।
চারতলার পুরোটা নিয়ে বাড়িওয়ালা থাকেন।
তার দুই সংসার, দুই বউই তাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে এখানে থাকে।
শায়লার সাথে বড় বউ কথা বলছিল, তিনিই ওদের খেতে দিচ্ছিলেন।
তার কাছেই জানা গেল, দুই পক্ষের দুই ছেলে।
দুজনই বিয়েশাদি করে বউ নিয়ে থাকে এখানে।
তবে বউদের কাউকে দেখা গেলো না। ছোট ছেলের বউ বাপের বাড়িতেই বেশি থাকে।
যাইহোক খাওয়া শেষ করে ওরা উঠলো সেদিনের মতো।
কয়েকদিন কেটে গেল।
একদিন শায়লা কাজ করছিল, হঠাৎ কলিংবেল বাজলো।
দরজা খুলে দেখে সেই ছেলেটা।হাতে একটা খেলনা গাড়ি।
ছেলেটি বললো, তোমার বাসায় আসি?
শায়লা হেসে বললো, এসো বাবু।
ছেলেটা বাসায় ঢুকলো।
শায়লার বাসায় ড্রাইকেক ছিল, ও ড্রাইকেক আর কলা খেতে দিলো ছেলেটিকে।
ছেলেটি আপন মনে খেলছিল।
শায়লা বললো, তুমি খেলো বাবু, আমি গোসল করে আসি।
ছেলেটি মাথা নাড়লো।
খানিকক্ষণ পরে বের হয়ে দেখলো, আরিফ এসেছে।
শায়লা বললো, ওহ, তুমি এসেছো, দরজা কে খুললো?
ওই বাবুটা চলে গেছে?
আরিফ বললো, কোন বাবু, আমি কাউকে দেখিনি।
দরজা ভেজানো ছিলো, তুমি এমন রেখো না, নিচে মার্কেট, কত লোকজন আসে এখানে!
শায়লা ভীষণ অবাক হলো!
নিচে তাকিয়ে দেখলো, ছেলেটা কলা কেক কিছুই খায়নি!
শায়লার ভীষণ মন খারাপ হলো।
দুপুরের দিকে শায়লা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, রাস্তার ওই পারেই একটা রেস্টুরেন্ট।
এই সময়ে সিংগাড়া ভাজে।
রিক্সাওয়ালারা দাড়িয়ে রিক্সা থামিয়ে খায়, আরো কত ধরনের মানুষ আসে রেস্টুরেন্টে।
শায়লা উপর থেকে দেখে।
যে লোকটা ভাজে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে, লোকটা ঘেমে একাকার, ওখানে নিশ্চয়ই খুব গরম লাগে।
দু তিন পরে ছেলেটা আবার এলো, শায়লা দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলো, তুমি না বলে চলে গেলে কেন?
কিছু তো খেলেও না!
তোমার নামটাও জানা হয়নি!
ছেলেটি কথা না বলে খেলতে লাগলো।
একবার শুধু বললো, আমার নাম টুনু।
শায়লা কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো, তোমার বাসা কোথায়?
ছেলেটি বললো, এখানেই।
আর কোন কথা বলার আগ্রহ দেখালো না
আপন মনে বিড়বিড় করে কথা বলে আর খেলে।
আজও শায়লা চানাচুর মাখা খেতে দিলো কিন্তু ছেলেটি খেলো না।
রাতে শায়লা উল্টো পাল্টা স্বপ্ন দেখলো, ছেলেটি কারো কোলে বসে আছে, ওকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে ঘোমটা দেওয়া একজন, কিন্তু ও খেতে চাইছে না!
শায়লার ঘুম ভেঙে গেলো, ধরফর করে উঠে বসলো। জলতেষ্টায় বুক শুকিয়ে আসছে।
পাশেই আরিফ বেঘোরে ঘুমুচ্ছে।
কয়েকদিন পরে ছেলেটা আবার এলো।
শায়লাকে ওর আঁকা ছবি দেখালো।
বাবা, মা আর ছেলেটি, শিশুসুলভ আঁকা।
তাও শায়লার ভালো লাগলো।
এরপর মাঝে মাঝেই শায়লার কাছে ছেলেটি আসতো।
আপন মনে খেলতো বা ছবি আঁকত। নিঃসঙ্গ শায়লার ভালোই লাগতো।
এক শুক্রবারে বাড়িওয়ালার বাড়িতে দাওয়াত দিলো শায়লাদের।
বেশ বড়সড় আয়োজন ছিল, অনেক মানুষ এসেছে।
শায়লা ভেতরে গিয়ে বসলো, আজ ছোট ছেলের বউও আছে।
এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে শায়লার চোখে পরলো, একটি ছবি আঁকার খাতা।
শায়লার মনে হলো, এটা ও কোথাও দেখেছে।
শায়লা খাতাটা হাতে নিয়ে দেখলো, টুনুর আঁকা ছবি!
ছোট বউ এসে বললো, এটা এখানে এলো কি করে!একটু রাগতস্বরেই বললো, শায়লা অপ্রস্তুত ভাবে বললো, এখানেই ছিল, টুনুর খাতা দেখে দেখছিলাম।
বউটি ভীষণ চমকে উঠলো।
বললো, আপনি জানলেন কিভাবে, সোহানকে আমি
শুধু টুনু ডাকতাম!
শায়লা বললো, ও কোথায়, ওকে দেখলাম না কোথাও!
বউটি চুপ করে থেকে বললো, টুনু নেই, ও মারা গেছে তিন বছর আগে!
শায়লা চমকে উঠলো ভীষণ।
তবে কিছু বললো না এখনি!
শায়লা আর কিছু খেতে পারলো না।
অসুস্থ লাগছে বলে বাসায় ফিরে এলো!
শায়লার জ্বর এলো রাতে প্রচন্ড।
আরিফের অফিস যাওয়া হলো না।
দু তিন পরে একটু সুস্থ হয়ে শায়লা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
রাস্তার ওপাশে মনে হলো টুনু দাঁড়িয়ে আছে।
শায়লা ইশারায় ডাকার চেষ্টা করলো, কিন্তু টুনু আর তাকলো না।
আর কখনো টুনু শায়লার কাছে আসেনি।